ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪

চায়ের সমতল স্বর্গ

আরডিজেএ ডেস্ক

সংগৃহীত

সংগৃহীত

ভারতের দার্জিলিংয়ে যদি চা চাষ হতে পারে, তাহলে পঞ্চগড়ে কেন নয়? এই সরল প্রশ্ন থেকে শুরু হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে প্রশ্নটি করেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেন এটাকে শুধুই একটি প্রশ্ন হিসেবে নেননি। ভারত থেকে চারা সংগ্রহ করে তাঁর বাংলোর একটি টবে রোপণ করে চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর টবের চারা দ্রুত ডালপালা ছেড়ে বাড়তে থাকে। রবিউল হোসেনের পক্ষে তখন কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না, টবের ওই চারাগাছের মধ্যে আসলে উঁকি দিচ্ছে পঞ্চগড়ে চা চাষের ভবিষ্যৎ।

২০ বছর পর পঞ্চগড় জেলায় এখন যেদিকেই তাকানো যায়, দিগন্তবিস্তৃত চা–বাগান। পুরো জেলার চেহারা বদলে গেছে। এখন জেলার ২ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। সরকারের নিবন্ধিত টি এস্টেট বা চা–বাগান আছে ৮টি। আরও ১৮টি অনিবন্ধিত চা–বাগানে চাষ হচ্ছে। এর বাইরেও ক্ষুদ্র পরিসরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩ হাজার বাগান। ২০১৭ সালে জেলায় প্রায় ৫৫ লাখ কেজি কাঁচা চা উৎপাদিত হয়েছে।প্রতিবছরই চা আবাদের পরিধি বাড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে পাশের ঠাঁকুরগাও, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায়। যে হারে চায়ের আবাদ বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই অঞ্চল থেকে বছরে ৩ কোটি কেজি সবুজ কাঁচা চা–পাতা আহরণ করা সম্ভব বলে জানান চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

পঞ্চগড়ে চা চাষের সম্ভাবনা উঁকি দেওয়ায় বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৯৯ সালে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে জরিপ চালায়। ২০০০ সালের দিকে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড ও কাজী অ্যান্ড কাজী চা–বাগান প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। ২০০১ সালেই সেখানে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) একটি উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বোর্ডের কর্মকর্তাদের পরামর্শে পঞ্চগড়ে মতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ইসহাক আলী মণ্ডল, আবদুর রহমান, আবুল হোসেনসহ ছয় থেকে সাতজন ক্ষুদ্র চাষি চা চাষ শুরু করেন।

মাটির ধরনের কারণে এই এলাকার জমিতে নিয়মিত ফসলের আবাদ তেমন হতো না। দাম না পাওয়ায় চাষিরা ফসল চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলেন। চা চাষ তাঁদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন জমি চা চাষের আওতায় আসছে। কারখানার মালিকেরাও ঋণ সহায়তা দিয়ে চাষিদের নতুন নতুন বাগান করায় আগ্রহী করে তুলছে। কৃষকের বসতবাড়ির আশপাশসহ পতিত জমিতেও এখন ছোট ছোট চা–বাগান চোখে পড়ে। কেবল ২০১৭ সালেই ৪২০ দশমিক ২৩ হেক্টর জমি নতুন করে চা চাষের আওতায় এসেছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, পঞ্চগড় হিমালয় পাদদেশের সমতল প্রান্তভূমি। সিলেটের চেয়ে এখানকার মাটি চা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। সীমান্তের ওপারে দার্জিলিংয়ের চা পৃথিবীখ্যাত। বড় বিনিয়োগ ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানেও চা–শিল্পের আরও প্রসার হবে।

শামীম আল মামুন আরও বলেন, এই এলাকায় চা চাষ সম্প্রসারণের প্রবণতা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে উন্নত জাতের চায়ের আবাদ বাড়ালে চাষি ও বিনিয়োগকারীরা আরও লাভবান হবেন।

গম, ভুট্টার চেয়ে লাভ বেশি হওয়ায় ছোট চাষিরা চা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। চা-বাগানে কর্মসংস্থানের সুযোগও হচ্ছে অনেকের। কয়েক বছরের মধ্যে এই চা চাষ বদলে দিয়েছে গোটা পঞ্চগড় জেলার অর্থনীতির চিত্র। একসময় যে পতিত জমি ব্যবহৃত হতো গোচারণের কাজে, এখন তা চায়ের সবুজ পাতায় ভরে গেছে। এসব চা–বাগানে প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। কর্মসংস্থানেও এটি এক বিরাট উল্লম্ফন।

তেঁতুলিয়ার একটি বাগানে কাজ করছিলেন সন্তোষ রায় (৪৭), হাজেরা খাতুন (৪৩), ফাতেমা বেগমসহ (৩৮) কয়েকজন শ্রমিক। ফাতেমা বেগম বলেন, আগে পাথর ভাঙার কাজ করতেন। ওই কাজ করতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সেই থেকে চা–বাগানে কাজ করছেন। এখানে দৈনিক মজুরি পান ১৭০ টাকা।

বাগানে নিড়ানি দিতে দিতে একটি কুঁড়ি ও দুটি পাতা দেখিয়ে হাজেরা বলেন, ‘এই কুঁড়িতেই হামার রুটি-রুজি। চা–বাগান হামার মত অনেক মানুষের কামাইয়ের রাস্তা দেখাইছে।’

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার রওশনপুর গ্রামের চাষি আবু মনসুর আলী। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চাকরি থেকে অবসর নিয়ে চা চাষ শুরু করেন। তাঁর আবাদি জমির পরিমাণ আট বিঘা। আগে তিনি গমের চাষ করতেন। আর বাকি সময় পড়ে থাকত। এখন চা চাষ করে বছরের সাত মাসেই তাঁর আয় প্রায় দুই লাখ টাকা।

পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়ক ঘেঁষে মাঝিপাড়া গ্রামে স্কুলশিক্ষক ইয়াসিন আলীর বসতবাড়ি। বাড়ির সামনের পাঁচ শতক জমি পড়ে ছিল। বছর দুয়েক আগে সেই জায়গায় চায়ের চারা রোপণ করেন তিনি। ইয়াসিন আলীর স্ত্রী রওশন আরা বেগম জানান, গত বছর এই চারাগুলো থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকার সবুজ চা–পাতা বিক্রি করেছেন তাঁরা।

চা–চাষি মতিয়ার রহমান বলেন, চা চাষের শুরুতে চা কারখানার মালিকেরা ইচ্ছেমতো চা–পাতার দাম বেঁধে দিতেন। ফলে চাষিরা পাতার দাম পেতেন না। কিন্তু এখন এলাকায় ১২টি চা কারখানা চাষিদের কাছ থেকে সবুজ পাতা কিনে চা উৎপাদন করছে। এখন চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। আর এ কারণে চাষিরা চা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

তেঁতুলিয়ার চা–বাগানের মালিক আবদুর রহমান বলেন, চা–পাতা বিক্রি সবচেয়ে সহজ। কারখানার মালিকেরা নগদ টাকা দিয়ে পাতা কিনে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চগড়ে সাধারণত ভারতের টোকনাই ভ্যারাইটি (টিবি) চা চাষ হচ্ছে। এই জাতের চা রোপণের দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে পাতা তোলা যায়। প্রতি একর জমির চা–বাগান থেকে টিবি জাতের চা পাওয়া যায় প্রায় ৮ হাজার কেজি। এ কারণে চাষিরা টিবি জাতের চা চাষের প্রতিই আগ্রহী। অন্যদিকে রং ও গন্ধ ভালো হওয়ায় চা গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিটি-২ জাতের চায়ের চাহিদা এখন শীর্ষে। এ জাতের চায়ের দাম অনেক বেশি। টিবি জাতের চা–গাছের পাতা উৎপাদন বেশি হওয়ায় পঞ্চগড়ের চাষিরা অন্য জাতের চা চাষে আগ্রহ দেখান না। ফলে চা–চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সিলেটের চা–বাগানগুলোতে শ্রমিকেরা হাত দিয়ে চায়ের পাতা তোলেন। আর পঞ্চগড়ের চাষিরা পাতা কাটেন ধান কাটার কাস্তে দিয়ে। হাত দিয়ে পাতা তুললে প্রতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৩২ দফা পাতা তোলা যায়। আর কাস্তে দিয়ে পাতা কাটার কারণে নতুন কুঁড়ি আসতে সময় লাগে। দক্ষ শ্রমিকের অভাবে পঞ্চগড়ের চাষিরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতি পঞ্চগড় জেলার সভাপতি আমিনুল ইসলাম জানান, চা–শিল্পের প্রসারের জন্য চা আমদানি নিরুৎসাহিত করা, সরকারি উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে কারখানা স্থাপন এবং চা চাষে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা নিলে এ এলাকায় চা–শিল্প আরও প্রসারিত হবে।

পঞ্চগড়ে ১২টি চায়ের কারখানা আছে। তেঁতুলিয়ার বাংলা টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালক (উৎপাদন) ফিরোজা বেগম জানান, তাঁরা চা–চাষিদের সঙ্গে সমন্বয় করে পাতা কিনছেন। ফলে ক্ষুদ্র চা–চাষিরা লাভবান হচ্ছেন।

চা কারখানা সমিতির সহসভাপতি ও নর্থ বেঙ্গল চা কারখানার চেয়ারম্যান শাহিরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আগে এলাকার অধিকাংশ জমি পতিত ছিল। গত তিন-চার বছরে এলাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে, তা হয়েছে চা–শিল্পকে ঘিরে।

শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের ৩ হাজার হেক্টর জমিতে চা আবাদ হচ্ছে। আরও ১৫ হাজার হেক্টরে চা আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থকরী ফসল হিসেবে ওই অঞ্চলের মানুষ চা চাষকে খুবই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। সার্বিকভাবে পঞ্চগড়সহ ওই অঞ্চলে চা–শিল্পের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় চা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানি টি লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এবং টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সান্তনু বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, দেশে চায়ের চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ছে না। চাহিদার এই ঘাটতি পুষিয়ে দেবে পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের সমতলভূমিতে চায়ের চাষ। তবে সেখানকার চায়ের সবুজ পাতার মান আরও নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দেশের ভেতরে এটির বাজার সম্প্রসারিত হবে।

সূত্র: প্রথম আলো

প্রতিবেদনটি লিখেছেন: তুহিন সাইফুল্লাহ ও মজিবর রহমান খান, পঞ্চগড়

প্রকাশিতের তারিখ: ১ এপ্রিল, ২০১৮

সর্বশেষ